Tuesday, September 01, 2020

আমার শহর



                                                                        

প্রথম পর্ব



– " বিয়ের পর থেকে তোর বাবার সাথে কম তো ঘুরলাম না। পুনে, ব্যাঙ্গালোর, রায়পুর, ত্রিচি কত শহরেই তো থেকেছি আমরা। শেষে এই দিল্লী এসে থিতু হলাম। কিন্তু, কলকাতার মত আর কোন জায়গা নেই। যদি বলিস কেন? হয়তো কারণটা ঠিক বলতে পারব না। ভাললাগার কি আর সবসময়ে কারণ থাকে রে।" – এরকম করেই বলতেন কল্যাণী। 


 চুপ করে নবনীতা ও শুনত না। উল্টে বলে উঠত, " রাখো তো তোমার সবসময় কলকাতা কলকাতা। আর এতই যদি প্রিয়, তবে আর কোনোদিন যাও নি কেন? আমাকেও তো নিয়ে যেতে পারতে।"


  কল্যাণী জবাব দিতেন না। উপস্থিত থাকলে বরং মা মেয়ের কথার মাঝখানে অশোক বলে উঠতেন, " যেতে চাইলেই কি আর সব সময় যাওয়া যায় রে মা? যায় না।"  অশোক আর কল্যানীর হয়ত চোখের ইশারায় সহমর্মিতা আর যন্ত্রণার আদানপ্রদান হত। তখন ওসব দেখার বা বোঝার মন নবনীতার কোথায়?


  ক্যান্সার ধরা পড়ার তিন মাসের মধ্যে যখন কল্যাণী চলে গেলেন, নবনীতার মনে হয়েছিল অনেক কিছু বাকি থেকে গেল। কত কথা বলার ছিল মা কে। কত গল্প শোনার ছিল। কল্যাণী কোনোকিছুর সুযোগ দিলেন না।


  তাও ভালো নবনীতার বিয়ে দেখে গেছিলেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর একদিকে ভালোই হয়েছিল। ওই বাড়িতে নবনীতা থাকতে পারত না। বাবা কে দেখতে গেলেই কেমন বাড়িটা ফাঁকা লাগে। মা এর এত সাধের বাড়ি আর মা নেই। মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হয় নবনীতার।


  অভি অফিসের কাজে বরাবরের মত ব্যস্ত। নবনীতা কিন্তু কিছুতেই নিজের কাজে মনোযোগ দিতে পারছিল না। তাই ফ্রিল্যান্সিং ফটোগ্রাফি থেকে কিছুদিনের ব্রেক নিয়েছিল  ও। যদি একটু মনটা শান্ত হয়।

 

  কিছুদিন রান্না করার চেষ্টা করেছিল নবনীতা। মায়ের হাতের প্রিয় রান্নাগুলো। মা কে কোনোদিন জিজ্ঞেস ও করা হইনি, মা এর পাশে দাঁড়িয়ে শেখা ও হয়নি।  স্বাদ মনে করে নিজেই মুড়িঘন্ট ট্রাই করল একদিন। আর একদিন মায়ের স্পেশাল গার্লিক চিকেন। কোনোটাই খারাপ হয়নি। কিন্তু মায়ের হাতের সেই স্বাদ আসেনি। 


এর মধ্যেই অভির ট্রান্সফার হওয়ার সম্ভাবনা জানিয়েছিল অফিস থেকে। একদিন  অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে অভি বলল, " মনে হচ্ছে এত খাটনির ফল পাচ্ছি। সিনিয়র পোস্টের দায়িত্ব দিচ্ছে কিন্তু দিল্লী থেকে হবে না। "


চায়ের জল চাপাতে চাপাতে নবনীতা জিজ্ঞাসা  করে, "কোথায়?" একটু বিরক্ত ও লাগে ওর।

  

–"ব্যাঙ্গালোর গিয়ে সাউথের অপারেশন দেখতে বলছিল বাজাজ। তবে এই পোস্টিং খুব বেশি দিনের নয়, খুব বেশি হলে এক বছর। তার কমেও হয়ে যেতে পারে। তখন কোম্পানি অন্য ভাবনা ভাববে।"  হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলে অভি।


– " তো কবে যাচ্ছি আমরা ব্যাঙ্গালোর?" দুজনের চা নিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করে নবনীতা।


      –" বেশি সময় নেই। টু উইকস। তবে, ব্যাঙ্গালোরে না। কলকাতা। ওটা সেকেন্ড অপশন ছিল। আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি।" চায়ে চুমুক দিয়ে বলে অভি।


– " কলকাতা!"  এতদিন পর তাহলে এভাবে সেই ছোটবেলার থেকে শোনা কলকাতার সাথে আলাপ হবে। মায়ের শহর। মায়ের বেড়ে ওঠা, বাবার সাথে আলাপ – সবকিছুর পটভূমি কলকাতা। যেখানে মা আর কোনোদিন ফিরে যায়নি। নবনীতা কিন্তু যাবে। 


      –" ওই, কোথায় হারিয়ে গেলে? খুশি তো এবারে? টুরিস্টের মত  সাত দশ দিনে নয়, অনেকদিন ধরে কলকাতা দেখতে পারবে। আন্টির কলকাতাকে খুঁজতে পারবে এখনের শহরের মধ্যে। ডিস্টার্ব করার জন্য আমিও থাকবনা কারন প্রচুর ট্যুর করতে হবে নর্থ বেঙ্গল আর নর্থ ইস্টে। খুশি তো?"


     – " কি করে বুঝলে?"

       – " আরে বিবি, তোমার মনের কথাই যদি না বুঝি তিন বছর তাহলে প্রেম করে আর বিয়ে করেছি কি করতে। এবার কলকাতার প্রিপারেশন শুরু করে দাও।" অভি আজ দারুন মুডে।


      নবনীতা মনে মনে ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল। ওদের দুজনের একসাথে কাটানোর সময় কমে যাবে। অবশ্য বেশি দিনের জন্য নয়। তবে ও নিজের ইচ্ছে মত কলকাতা ঘুরে মা কে খুঁজতে তো পারবে।  


  

দু সপ্তাহের মাথায় কলকাতা এয়ারপোর্টে ফ্লাইট থেকে নামতে নামতেই অভি বলল, " এ তো প্রচন্ড হিউমিড। এপ্রিলেই এরকম হলে মে জুনে তো হালত খারাপ হয়ে যাবে।"


      কথাটা ভুল নয়। কিন্তু, নবনীতা তখন কলকাতাকে প্রথমবার দেখছিল। মায়ের মায়া চশমা পরে। দেখা যাবে কে জেতে কলকাতার প্যাচপ্যাচে গরম আর ওর মায়ের শহরের মধ্যে। 


                                      * * *


      কলকাতা আসার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। প্রথম কিছুদিন হোটেল থেকে তারপর সল্টলেকে বাড়িটাও বেশ পাওয়া গেছে ভালো। নবনীতার যদিও ইচ্ছে ছিল উত্তর কলকাতায় থাকার।কিন্তু, এই বাড়িটা সবদিক দিয়েই ওদের দুজনের পছন্দ হয়ে যাওয়ায় আর ভাবেনি। জিনিসপত্র গোছাতে কয়েকটা দিন সময় লেগেছিল, তারপর নবনীতা আস্তে আস্তে নিজের কাজকর্ম আবার শুরু করে। নতুন কিছু অ্যাসাইনমেন্ট আসার পর ওই ছবি তোলার কাজে এদিক ওদিক বেরোতে শুরু করল ও।  


      একটা ওয়েব পোর্টাল এর জন্য পার্ক স্ট্রিটের দিকে যেতে হয়েছিল।  শ্যুট মিটে যাওয়ার পর অনেকটা সময় হাতে থাকায় কি করি, কি করি ভাবতে শুরু করল নবনীতা। যেই জন্য কলকাতায় আসা, এখনো তা শুরুই হয়নি।  মা তো এদিকের কথাও খুব বলত।  হ্যাঁ, ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামেই তো বাবা আর মা আসতো। তবে এটা দিয়েই শুরু হোক। এই ভেবে মিউজিয়ামে ঢুকে পড়ল নবনীতা।


      ভাস্কর্যের গ্যালারিতে আনমনা হয়ে মূর্তিগুলো দেখছিল ও। হটাৎ ঘড়ি দেখে খেয়াল হল তিনটে বেজে গেছে। বাড়ি ফিরে ছবিগুলো প্রসেসিং করতে আরো কয়েক ঘন্টা লাগবে। ডেডলাইন কাল হলেও একদিন আগেই কাজ সেরে নেওয়ার অভ্যেস আছে ওর। এই ভেবে বেরোনোর জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে কে ডেকে উঠলো– 


– "এই যা, সরে গেলে। আর আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে যাও না, প্লিজ। অনেকটা হয়ে এসেছে।" 


আর্ট কলেজের অনেকেই মাটিতে বসে আঁকছিল। তাদের মধ্যে আলাদা করে খেয়াল না করলেও এখন ওই ছেলেটার কথা শুনে ফিরে তাকালো নবনীতা।


– "এক্সকিউজ মি?" কৈফিয়ৎ চাওয়ার সুরে বলে নবনীতা।

 – "না, মানে, আমি নই,  তোমার ছবিটা আঁকতে শুরু করে দিয়েছিলাম। বেশ কিছুটা হয়ে এসেছে। আর যদি একটুখানি দাড়াও তাহলে মোটামুটি ব্যাপারটা ম্যানেজ করে নেয়া যাবে।" একটু কাচুমাচু মুখেই ছেলেটা বলে। কুড়ি একুশ হবে হয়ত খুব বেশি হলে।।

  

      এদিকে চট করে মাথা গরম হয়ে যায় নবনীতার, " আঁকার আগে পারমিশন নেওয়াটা জরুরি মনে করোনি।দেখি, ছবিটা দাও।"  হাত বাড়ায় ওর দিকে নবনীতা।


      –" আরে, কি করছো কি? ছবি শেষ হওয়ার আগে আমি কখনো কাউকে দেখাই না।" ড্রইং বোর্ড নিজের দিকে আঁকড়ে ধরে ছেলেটা।


      –" আজব তো। একে তো পারমিশন না নিয়ে ছবি আঁকছো, আবার বলছ আমাকে দেখাবে না। দাও বলছি। নাহলে আমি কিন্তু তোমার নামে কমপ্লেন করব।" 


নবনীতার কড়া কথাবার্তা শুনে আর কথা বাড়ায় না ছেলেটা। কাচুমাচু মুখে একটা কাগজ তুলে দেয় নবনীতার হাতে।


       কাগজ দেখে একটু অবাক হয়ে যায় নবনীতা। এতে তো শুধু লাইন ড্রয়িং। বেসিক স্ট্রাকচার ছাড়া কিছুই নেই। একটু প্রশ্নের চোখে তাকায় নবনীতা ।

 

     – " বেসিক আউটলাইন করে নিচ্ছি,  বাকি আমার মাথায় ঢুকে গেছে। পরে আস্তে আস্তে করবো।" জবাবদিহির সুরে বলে ছেলেটা। সাপোর্টের জন্য আশেপাশে বন্ধুদের দিকে তাকায় ও। কিন্তু, কে আর যেচে এই ঝামেলায় জড়াবে।


     – " এটা আমি নিয়ে নিলাম।আর কিছু করতে হবে না।" কাগজটা রোল করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় নবনীতা।


     – "প্লীজ লেট মি এক্সপ্লেন। দশটা মিনিট দাও।" শেষ চেষ্টা করে ছেলেটা ওর ড্রইং উদ্ধার করতে।


– "আমার  এতো সময় নেই বুঝলে। " এই কথা ছুড়ে দিয়ে ছেলেটার বার বার বলা প্লিজ গুলোকে অগ্রাহ্য করে  গটগট করে গ্যালারি থেকে বেরিয়ে যায় নবনীতা


     বাড়ি ফিরে  ছবিগুলো এডিট এর কাজ শেষ করে অ্যাসাইনমেন্ট মেইল করে দেওয়ার পর একটা স্ট্রং কালো কফি নিয়ে বসল নবনীতা।


      মিউজিয়াম এর কথা ভেবে নিজেরই হাসি পাচ্ছিল। না, বাচ্চা ছেলেটাকে একটু কড়া ডোজ দেওয়া হয়ে গেছে। যাক,  এই লাইন ড্রইং রেখে ওর নিজের তো কোনো লাভ হবে না, বরং ফেরত দিলে তাও নিজের একখানা পোর্ট্রেট পাওয়ার আশা থাকবে। কিন্তু পাবে কোথায় ওই ছেলেকে। নামটাও তো জানা নেই। তবে, মনে  তো হয় আর্ট কলেজের স্টুডেন্ট। ওই মিউজিয়ামেই ধরতে হবে আবার। কফির খালি কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে ভাবে নবনীতা।




দ্বিতীয় পর্ব



  মিউজিয়াম ঢুকে গ্যালারিতে ছেলেটাকে কোথাও দেখতে পেল না নবনীতা। তবে আগেরদিনের ঝামেলাটা অনেকেই খেয়াল করায় একদিকে সুবিধাই হল। দু-একজন কে জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল যে, ও আজ মিউজিয়াম এ আসেনি। অবশ্য তাতে প্রবলেম হয়নি। ওর এক ক্লাসমেট, মিষ্টি করে একটি মেয়ে, ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিলো।

  প্রথমে একটু থতমত খেলেও তারপরে দেখা করতে রাজি হয়ে গেল ছেলেটা। আর্ট কলেজেই আছে। তাই তখনই দেখা করার প্ল্যান হল।


  মিউজিয়াম এর পুরোনো গেটের সামনে কিছুক্ষন পর প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে এলো ছেলেটা। এসেই বলে, "শোনো না, কমপ্লেন টমপ্লেন করো না। ছেড়ে দাও।"


 হাসিমুখে নবনীতা বললো, "ভয় নেই। আমিও একটু ওভাররিয়াক্ট করে ফেলেছিলাম। এই নাও, তোমার ছবির খসড়া।" কাগজটা ফেরতের জন্য বাড়িয়ে ধরে ও।


  –"থ্যাংক ইউ দিদি।" একটু নিশ্চিত হয় ছেলেটা।


  –"খবরদার! দিদি নয়। দিদি তো কলকাতায় একজনই আছেন। আমি নবনীতা।" একটু হালকা মেজাজেই বলল ও।


      –"হ্যাঁ হ্যাঁ, আলাপ টা ঠিক করেই করা যাক বলো। চা খাবে?" 


– "চল। অক্সফোর্ড এ চা বার এ যাওয়া যাক।" অফার করে নবনীতা।


      ওর অফার নস্যাৎ করে দিয়ে কলকাতার তরুণ বলে, "ধুর, তুমি এস আমার সাথে। চায়ের স্বাদ পেতে হলে মাটির ভাঁড়ে খেতে হয় বুঝলে।"


      সদর স্ট্রিট এ দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বেশ মজা ই লাগছিলো নবনীতার। মায়ের বারবার বলা সেই কলকাতার উষ্ণতার ছোঁয়া পাচ্ছিল যেন ও।


      – "আমি অর্ক। অর্কদীপ সেন। আমি কিন্তু পোর্ট্রেট এমনিতে আঁকি না। কিন্তু কাল তুমি যেভাবে আনমনা হয়ে ওই মূর্তি গুলো দেখছিলে, পুরো কম্পজিশনটা একটা ছবি হয়ে গেল মাথায়। আর কিছু না ভেবেই শুরু করে দিয়েছিলাম।" আলাপের সঙ্গে কৈফিয়ৎ ও দেয় অর্ক।


      – "আরে থামো। আমি কিন্তু এমনি এমনি আলাপ করছি না। শর্ত আছে।"  একটু গম্ভীর হয়ে বলে নবনীতা।


      – "এই সেরেছে।" অর্ক আবার চিন্তায় পড়ে।


      –"চিন্তার কিছু নেই। প্রমিস করো যে না বলে আর কোনোদিন এভাবে কারোর ছবি আঁকবে না। আর..."


     – "না না, আর না দিদি। সরি, নবনীতা।" নবনীতার ভুরু কুঁচকানো দেখে নিজেকে ঠিক করে অর্ক।


  – "দাড়াও। আরো আছে। মাথায় যে কম্পসিশন এসেছিল, সেটা কমপ্লিট করে পোর্ট্রেটটা করে দিতে হবে।"


  – "ওহ,এই ব্যাপার। ওকে ওকে। কিন্তু...সময় লাগবে কিন্তু।" রিলাক্সড হয় অর্ক।


  – "সে লাগুক নাহয়। তবে যদি পছন্দ না হয়,তাহলে কিন্তু সোজা পুলিশ এ দিয়ে দেব।" আবার সুর বদলায় নবনীতা।


  –"যাস শালা!! তুমি তো সাঙ্ঘাতিক জিনিস।"


  –"তাও ভালো বুজতে পেরেছিস।"


  –"আচ্ছা,  আর কিন্তু দু'একদিন কিছুক্ষণ টাইম দিতে হবে ছবিটা কমপ্লিট করার জন্য।"


  –"আবার দু একদিন? এই যে কাল বললি আধঘন্টা দাঁড়ালেই হয়ে যাবে?"


  –"কালকে? যা মারমূর্তি  নিয়েছিলে তাতে দু মিনিটে যে বলিনি এই অনেক ভাগ্য ভালো।"


  – "আচ্ছা ঠিক আছে। আমিতো মিউজিয়ামে আরো কয়েকবার আসার কথা ভাবছি তখনই না হয় হয়ে যাবে।"


  – "তুমি কি কোনো কাজে আসবে? মানে এত ঘন ঘন তো আমরা ছাড়া আর কেউ আসেনা, তাই জিজ্ঞেস করছি।"


  – "না রে। কাজ তো আমার ফটোগ্রাফি রিলেটেড। কিন্তু মিউজিয়ামে আসবো অন্য কারণে। পার্সোনাল।"


  – "আরে, আপত্তি থাকলে বলতে হবে না।"


  –"না, তেমন কিছু নয়। আসলে আমার বাবা মা মিউজিয়ামে দেখা করতেন কোর্টশিপ এর সময়ে। বাড়িতে আপত্তি ছিল, আর তখন বাইরে অত দেখা করা সম্ভব ছিল না। মা গল্প করতেন যে এই বিভিন্ন গ্যালারি তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরতে ঘুরতেই ওদের কথা বার্তা হতো। এত শুনেছি, যে নিজে দেখে রিয়েলাইজ করার চেষ্টা করি, ভাবার চেষ্টা করি।" 


      – "তো মা বাবা কে সাথে নিয়েই আসতে পারতে। আরো জমাট হত।" 


      –" আই উইশ! মা চলে গেলেন কিছুদিন হলো।আর বাবা কলকাতা আসবেন না।"


      – "ওহ, সরি। কিন্তু বাবা আসবেন না কেন?"


  – "আসলে মা এর খুব ইচ্ছে ছিল কলকাতা আসার। খুব ভালোবাসতেন এই শহরকে, কিন্তু নিজের বাড়ির ওপর অভিমানে সেটা হয়ে ওঠেনি। সেই জন্য বাবা ও আর কলকাতা আসতে চান না।"


  – "আর তুমি?"


  – "আমি? আমি তো এসেছি মা এর জন্য। মায়ের শহর খুজতে, মায়ের শহর কে জানতে। মা খুব কলকাতার গল্প করতো। তো সেগুলোই মেলাতে এসেছি। ঐভাবে যদি মাকে একটু কাছে পাই।"


  – "তা, তোমার শহর কোনটা?" নবনীতার মুড বদলাতে টপিক বদলায় অর্ক।


  – "আমার? আমার কোনো শহর নেই। বাবার চাকরির কারণে অনেক জায়গায় থেকেছি, তো আমার শহর বলতে অনেকগুলোকেই বলতে হয়, আবার কিছুই না বলা যায়।"


  – "তুমি না নবনীতা, কোনো কাজের না। কদিন কোথায় থাকলে সেগুলো তো স্টাটিস্টিক্স। ও দিয়ে কি আর নিজের শহর হয়। নিজের শহর তো একটা আবেগ। আর আবেগ কবে লজিক এর ধার ধেরেছে?" 


  – " থাক, আর কাব্য করতে আসিস না। বরং আমায় বল তো ভালো ফুচকা কোথায় পাবো। মা খুব বলত, কলকাতার ফুচকা নাকি দিল্লীর পানিপুরীকে গোহারান হারাবে এনিটাইম। সেটা দেখতে হবে না?" 


  – "এই সেরেছে। ফুচকার খবর তো মেয়েদের থেকে নিতে হবে। এরপর যেদিন আবার সিটিং দিতে আসবে তখন বলে দেব।" একটু ভেবে বলে অর্ক।


  – "আরো সিটিং? আর শুধু বললে হবে না, সাথে নিয়ে যাবি। তোর শহরের গলিঘুঁজি আমার চেনা নেই।"


  – "সে হয়ে যাবে। আমার তো নিজের শহর দেখাতে খুব ভালো লাগে।"


***


      কলকাতা আসার পর মাস দুুুই তিন কেটে গেছে নবনীতার। অভি এক সপ্তাহ বাড়ি থাকলে দু সপ্তাহ ট্যুরে কাটাচ্ছে। তাতে অবশ্য ওর আপত্তি নেই। নিজের কাজকর্ম  আর অর্কর সঙ্গে কলকাতা এক্সপ্লোর করে দিব্বি কাটছে নবনীতার। 


     নতুন কিছু অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছে নবনীতা। ওর কাজের ব্যাপারেই একটু কুমোরটুলি যাওয়ার ছিল। অর্ক প্রথমে শুনে বলছিল, "নির্ঘাত সেই ক্লিশে ছবি তুলবে।"


  কুমোরটুলীতে ঘুরে ছবি তুলতে তুলতে ওকে বোঝাচ্ছিল নবনীতা, " সেই এক জিনিসের জন্য থোড়াই কেউ পয়সা দেবে। গল্প খুঁজতে হয়। আমরা সবাই গল্প ভালবাসি। আমার ছবির সঙ্গে কিছু লেখা দিয়ে একটা ফিচার মত করে পাঠাই।  

  যেমন ধর, প্রতিমার চোখ আঁকার ফটোগ্রাফ। ক্লিশে। আমার লেখায় থাকল কোনদিন কুমোরটুলীর বাইরে না বেরোনো শিল্পীর কথা, যিনি দেশ বিদেশে যাওয়া প্রতিমার দৃষ্টিতেই দুনিয়া দেখছেন। অথবা, ধর ওই সেদিনের কথা। বেথুনের সামনে তিরিশ বছর ধরে বসা ফুচকাওয়ালার কাছে নিয়ে গেলি যে। 


  এমনিতে মনে হবে একটা মেয়ে ফুচকা খাচ্ছে। কিন্তু, ওর সাথে আমার কলকাতায় আসার কারণ আর হয়ত মা ও ওনার কাছে ফুচকা খেতেন, জুড়ে দিলেই  ছবিটা একটা সুন্দর গল্প প্রেজেন্ট করবে।"


কাজ সারার পর এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নবনীতা বলে, " মার কাছেই শুনেছি কুমোরটুলীর কথা। ওদের বাড়ি তো কাছাকাছি ছিল।"

 

অর্ক বলে " তো চলে যাও মামারবাড়ি। আদর খেয়ে এস।" 

   

 দীর্ঘশ্বাস ফেলে নবনীতা বলে, " আমি চিনিও না। কোনদিন যাইনি। কলকাতাতেই তো প্রথমবার এলাম।"


   অবাক অর্ক বলে, "সে কী? তুমি কোনোদিন তোমার  মামার বাড়ি যাওনি?"

  

  – " না রে।  বাবা-মার বিয়ে ওরা কেউ মেনে নেয়নি, তাই কোন যোগাযোগ ছিল না, সম্পর্ক ছিল না। মায়ের কাছে গল্প শুনে কলকাতার দেখার ইচ্ছে হলেও, মামা বাড়ি আসার জন্য তাগিদ কোন বোধ করিনি।  তবে এখন ভাবি একবার গেলে হয়। মামার বাড়ি না,  মায়ের বাড়ি। মা যেখানে বড় হয়েছেন।  অনেক গল্প শুনেছি তো ২৬/১, গোপী মোহন দত্ত লেনের। শুনে  তিনতলা বাড়িটার, বাড়ির সামনের দরজার উল্টোদিকের ছাতিম গাছটার, পেছনের বাড়ির ছাদে দত্ত কাকিমাদের আচার শুকনোর– মনে হয় সব অনেক চেনা। একবার দেখে আসলেই হয়।" নবনীতা কেমন যেন কল্পজগতে হারিয়ে যায় বলতে বলতে।


নবনীতাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনতে অর্ক বলে, " আচ্ছা, বুঝেছি। এবার একটু চলো তো আমার সাথে।  এই তো, আর একটুখানি... একটু কাজ আছে। "


এদিক ওদিক দেখে মিনিট তিন চার হেঁটে দু তিনটে গলি পেরিয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে থামে অর্ক। পুরনো দিনের বেশ বড় বাড়ি। কড়া নাড়তে গিয়েই দেখলো পাশে কলিং বেল ও রয়েছে।


আশেপাশে তাকাতে তাকাতে  অর্ককে ডেকে বলল নবনীতা, " দেখ, দেখ, এইখানেও একটা ছাতিম গাছ।"


কলিং বেল বাজিয়ে দুষ্টু হাসিমাখা মুখে অর্ক বলল, "বাড়ির ঠিকানা টা দেখেছো?"


অর্কর কথায় নজর দেয় নবনীতা দরজার পাশের বোর্ডটায়, "২৬/১, গো... মানে? তুই কী..."


– " হ্যাঁ, ঠিক। এটাই। এটাই তোমার মামারবাড়ি। ভাবতে ভাবতে অনেককাল কাটিয়ে দিলে। এবার ঢুকে পড়।"  বলেই টেনে এক ছুট দিল।


  হতভম্ব হয়ে নবনীতা একবার অর্কর চলে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকায়, একবার সামনের দরজার দিকে তাকায়। ভেতর থেকে আওয়াজ পাওয়া যায় দরজা খোলার। আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে, অর্কর পেছন পেছন নবনীতা ও দৌড় মারে।


  গলির বাইরে এসে দেখে বাবু ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন। নবনীতা ও হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, "স্কাউন্ড্রেল ! এটা কি ছিল ! এ- এভাবে হয়?"


  – " একবার ভাব তো, যে তুমি গেলে না ওই বাড়ি। আজকের কথা না, কোনোদিনই গেলে না। কলকাতার মেয়াদ ফুরোলে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেলে অন্য কোথাও। সারা শহর ঘুরে নিলেও আক্ষেপ থাকবে না ? মায়ের শহরে এসে মায়ের বাড়ি না যাবার ?"  বড়রাস্তার দিকে এগোতে এগোতে হঠাৎ যেন সিরিয়াস হয়ে যায় অর্ক।


দুর্বল যুক্তির আড়ালে আশ্রয় খোঁজে নবনীতা, " তুই জানিস না। ওরা কোনোদিন মেনে নেয়নি..."


  – " তোমার বাবা মায়ের বিয়ে মেনে নেয়নি তো। হয়তো তোমার মুখের ওপরেও দরজা বন্ধ করে দেবে। কিন্ত, যদি তা না হয়? জানতে না চাওয়াটাকে মেনে নিতে পারবে তো? ভাব। পরে আফসোস করো না। ভাব। এই রে, আমার বাস আসছে, চললাম।" এই বলে, নবনীতার মনে প্রশ্ন জাগিয়ে বাগবাজার মোড় থেকে চট করে একটা বসে উঠে পড়ে অর্ক।  ট্যাক্সি ডাকার কথা ভুলে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নবনীতা।


তৃতীয় পর্ব



বাগবাজার থেকে ফিরে ঘরে চুপ করে বসেছিল নবনীতা। কিছু কিছু সময় থাকে না, যখন কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করে না, শুধু  চুপচাপ বসে থাকতে মন করে; নবনীতার ও তেমন মনে হচ্ছিল। অর্কর কথায় এতো গুরুত্ব দিচ্ছে কেন সেটা বার বার নিজেকেই প্রশ্ন করতে থাকে ও। উত্তর কিছুই আসে না। খুব রাগ হচ্ছিলো ছেলেটার ওপরে। কিছু না জেনেশুনেই আলপটকা মন্তব্য করার স্বভাব।  একদম ভালো লাগেনা এগুলো নবনীতার।  


কারোর সাথে কথা বলতে পারলে হতো এ নিয়ে। অভি ও আর সময় পেলো না ট্যুর করার।  আর এই সময় তো ফ্লাইটে থাকবে, ফোন লাগবে ও না।  বাবাকে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? ফোনটা হাতে নিয়েও রেখে দিলো নবনীতা।  না, থাক, এখন না।  ওখান থেকে এসেই নাহয় বাবাকে ফোন করবে। ইস, যদি মা এর সাথে কথা বলতে পারত ?


অবশ্য মা যে কি বলতো সেটা জানা আছে নবনীতার। ‘ নিজের কাজটা  ঠিক করে করো , অন্য কে কি করলো সে না দেখলেও চলবে।’ কম শুনেছে এই কথা সারাজীবন? তবে মা নিজেও মেনে চলত। বড় হয়ে নবনীতা বুঝেছিলো যে কেন কালীপুজোর দু একদিন পরে মায়ের সকালবেলায় খিদে পেত না। দাদাদের সাথে কোনো সম্পর্ক বা যোগাযোগ না থাকলেও তাদের কল্যাণকামনায় ভাইফোঁটার উপোস করত  মা, শুধু বলত না। 


সেই দাদাদের বাড়ি। না, মায়ের বাড়ি। নবনীতা যাবে, শুধুমাত্র মায়ের স্মৃতি খুঁজতে।  


দিনদুয়েক পর এক বিকেলবেলায় আবার নবনীতা হাজির হলো ঠিকানা মিলিয়ে ২৬/১ গোপী মোহন দত্ত লেনের বাড়িটার সামনে। একটুমনে জোর পাওয়ার জন্যই বোধহয় ঘাড় উঁচু করে উল্টোদিকের ছাতিম গাছটার  তাকিযে নাক টেনে ফুলের গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করল ও। না, এখন বোধহয় ফুলের সময় নয়।  


আর একবার ঠিকানাটা মিলিয়ে নিল নবনীতা।এখনও সময় আছে। চাইলেই ফিরে যাওয়া যায়।  হ্যাঁ-না এর মাঝে ভাবতে ভাবতে শেষ অবধি বেল বাজিয়েই দিল নবনীতা। 


কোন সাড়াশব্দ নেই। মুহূর্ত গুলো ও যেন কাটছে না।  অধৈর্য হয়ে আর একবার বেল বাজিয়ে দিলো নবনীতা। 

 

       -- “ আসছি রে বাবা, আসছি।  একটু ও তর সয় না, কিসের এতো তাড়া  কে জানে “ ভেতর থেকে গজগজ করতে থাকা মহিলার গলা শুনে নবনীতা আবার ভাবতে থাকলো এসে ঠিক করেছে কিনা।  


       ভুল যে করেনি সেটা বুঝতে পারলো যখন দরজা খোলার সাথে সাথে ভেতরে চোখ পড়ামাত্রই মা এর কথা মনে করে বুকটা ধুক  করে উঠলো।  


       আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এক বছর ত্রিশের মহিলা জিজ্ঞেস করলেন , “ কাকে চাই? “ . বোধহয় কাজ করতে করতে উঠে এসেছেন। 


    কাকে চাই নবনীতার? কি উত্তর দেবে ও? একটু ভেবে বলল , “ আমি কল্যাণী সেনের মেয়ে “ 

    

--” একটু দাঁড়ান, ভেতরে গিয়ে বলি।” 

    

        কিছুক্ষনের মধ্যেই ভেতর থেকে এক মাঝবয়সী মহিলা এসে চোখেমুখে প্রশ্ন নিয়ে নবনীতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ তুমি? “

        -- “ আমি নবনীতা। আমার মা কল্যাণী সেন।  


              যে উত্তরের অপেক্ষায় ছিলেন তা পেয়ে উনি পিছন দিকে তাকিয়ে কৌতূহলে অপেক্ষা করতে থাকা প্রথমের মহিলাকে বললেন, “ জবা , তুই ভেতরে গিয়ে কাজ শেষ কর. আমি এখানে আছি।  “ তারপর নবনীতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ এসো মা, ভেতরে এসো।”

 

             মায়ের বাড়ি পা রাখলো নবনীতা।  


           ঘরের ভেতরে নবনীতাকে বসিয়ে মিনিট খানেকের জন্য ভেতর থেকে ঘুরে এলেন উনি। এদিকে নবনীতা কিছুই বুঝতে পারছিল না যে কি বলবে, বা কি কথা দিয়ে শুরু করবে। উনিই শুরু করলেন, " কলির খবরটা জেনে খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল, জানো। "   

– "কলি?" নবনীতা ঠিক বুঝতে পারে না কি বলছেন উনি।

– " ওহ, তুমি তো জানো না। তোমার মা, কল্যানীর ডাক নাম কলি। তাই ডাকতাম আমরা সবাই।"


           মায়ের ও ডাক নাম ছিল? ভালবেসে লোকজন ডাকত? ভাবতে অবাক লাগে নবনীতার। মনটাকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে বলে, " আমি কিছুদিনের জন্য কলকাতায় এসেছি। মা খুব কলকাতার কথা বলতেন তো, সেজন্যই…"  


          উনি যেন বুঝে যান ও কি বলতে চাইছে।  মাথা নেড়ে উনি বললেন, " তুমি তো আমায় চিনবে না। চেনার কথাও নয়। আমার নাম মাধবী। আমি তোমার বড়মামী। জানো তো, কলি আর আমি বৌদি ননদ কম, বান্ধবী ছিলাম বেশী। অশোকের কথা এবাড়িতে আমাকেই সবার আগে বলেছিল।" গলাটা একটু নামিয়ে এবারে বললেন, " ওদের বিয়ের সাক্ষী ও দিয়েছিলাম আমি, জানো।"


           এবার অবাক হওয়ার পালা নবনীতার, " তাই নাকি? এটা জানতাম না তো?" 


           – " হ্যাঁ, এ বাড়িতে শুধু আমি জানতাম যে ওই দিন রেজিস্ট্রি করছে ওরা। আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু… বাবা, দাদা, বোন- জেদ তো কারোর কম ছিল না। কি আর করতাম। মেয়েটার বিয়েতে বাড়ির কেউ থাকবে না এটা হয় নাকি? ওরা দুজনেই আমায় দেখে অবাক হয়ে গেছিল। তারপর একসাথেই বাড়ি ফিরেছিলাম আমি আর কলি। আর তার পরদিনই তো... না না, আজ তুমি প্রথমবার এলে, আজ কোনো মন খারাপের কথা নয়।" আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন মাধবী।


          – " আমার এ বাড়িতে আসা কিন্তু দুঃখের থেকেই। আসলে মা কে খুব মিস করি তো। ভাবলাম তাই.."


          – "তাই যদি কিছু স্মৃতির টুকরো পাওয়া যায়।" নবনীতার কথা সম্পূর্ণ করেন মাধবী। " একদম ঠিক করেছ। আমরা যদি এইটা অনেক আগে করতে পারতাম। পুরোনো অ্যালবাম গুলো জানি সব কোথায় আছে। এক কাজ করো তো মা, তোমার ফোন নম্বর আর ঠিকানাটা একটু দাও তো আমায়। ওগুলো পেলে জানাবো। ঝিমলি, একটা কাগজ পেন নিয়ে একটু এঘরে আয় তো একবার।" ডাক ছাড়েন মাধবী।


          বছর সাত আটের একটি বাচ্চা মেয়ে ভেতর থেকে খাতা পেন্সিল নিয়ে আসলে তাতে সল্টলেকের ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিল নবনীতা।  ততক্ষনে ভেতর থেকে এক প্লেট মিষ্টি আর জলের গ্লাস এসে পড়েছে। নবনীতার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে মাধবী বললেন, " প্রথমবার এলে। এটুকু তো মুখে দিতেই হবে।" 


         একটু সন্দেশ ভেঙে মুখে দিয়ে এক ঢোক জল খায় নবনীতা। আর মাধবী গল্প করতে থাকেন।


        বাবা আর দুই দাদার নয়নের মণি কল্যানীর কথা। কি করে তাকে কেউ কোনোকিছুতে না বলতেন না সেই কথা। ওর পছন্দ, বিচার বিবেচনায় বাড়ি শুদ্ধ সবার  গর্বিত হবার কথা। মাধবীর সঙ্গে বাজি লড়ে ফুচকা খেয়ে পরে বাড়ি এসে পেট ব্যাথায় কষ্ট পাওয়া কলির কথা। 


         নবনীতা শুনতে শুনতে যেন হারিয়ে যাচ্ছিল সেই সময়ে।  একটু একটু করে যেন চিনতে পারছিল এই বাড়িটা। এমন সময়ে ভেতর থেকে আবার জবা এসে ডাক দিল, " কাকিমা, ঠাকুমা জেগেছে। তুমি বলতে বলেছিলে তাই খবর দিয়ে গেলাম।"


         মাধবী নবনীতাকে বললেন, " চলো, একবার দিদার সঙ্গে দেখা করবে। অসুস্থ হলেও চিনলে খুশি হবেন। দেখা করে নিয়ে তারপর তোমায় ছাদে নিয়ে যাচ্ছি।


          ওনার পেছন পেছন ভেতরে গেল নবনীতা। ভেতরে দুটো ঘরের পরেই আরেক ঘরে ঢুকলেন মাধবী।পুরো ঘরটাতেই কেমন ওষুধ ওষুধ গন্ধ। শেষদিকে মায়ের ঘরেও এমন গন্ধ বেরতো। খাটের ওপরে বসে জল খাচ্ছেন এক বৃদ্ধা মহিলা। নবনীতাকে ওনার কাছে নিয়ে গিয়ে মাধবী বললেন, " মা, কে এসেছে দেখো। কলির মেয়ে- নবনীতা।"


         দিশেহারা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা বলেন, " কলির মেয়ে? এত বড় হয়ে গেছে?" 


        প্রণাম করার জন্য হাত এগোয় নবনীতা। বৃদ্ধা বলে চলেছেন, " কলি রে! কেন যে ওই অনাথ ছেলেটাকে বিয়ে করলি?" বাড়ানো হাত থেমে যায় নবনীতার।


        সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধাকে সতর্ক করা মাধবীর  " "মা" অগ্রাহ্য করে নবনীতা বলে," অনাথ ছেলেটি আমার বাবা। ওনার নাম অশোক। কিচ্ছু বদলায়নি এই বাড়িতে। কিচ্ছু বদলাবেন না আপনারা।"  এই বলে সোজা বেরিয়ে পড়ে ও। ঘর থেকে, ওই বাড়ি থেকে, মোহ থেকে। দুইদিকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অসহায় মাধবী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আবার।


চতুর্থ পর্ব 


      মেয়ের ফোন পেয়ে পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় অশোকের। সেই কলকাতার কথা। কল্যাণীদের সেই বাড়ি। বার কয়েক তো উনি নিজেও গেছেন।


  সেই প্রথমবার। আত্মবিশ্বাস আর ভালোবাসায় ডগমগ কল্যাণী বলেছিল, " চলো তো একবার। আমি তোমার কথা বলে রেখেছি। দেখবে ভাই, দাদা, বাবা - সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করবে। আমার পছন্দ যে।" সে পছন্দ যে হয়নি তাও তো নয়।


  কল্যানীর ভাই কিছুক্ষন খেলা নিয়ে কথাবার্তা বলে নিজে বেরিয়ে গেছিল। কিন্তু দাদার সাথে অফিসের কথা আর ওর বাবার সাথে দেশের হালচাল এবং সাহিত্য নিয়ে আলোচনা বেশ জমে গেছিল। চায়ের কাপের সাথে দারুন একটা উপভোগ্য আড্ডার মেজাজ ছিল সেদিন কল্যানীদের বাড়িতে।খুব ভাল লাগছিল অশোকের এরকম পারিবারিক পরিবেশে।


  কল্যানীর বাবা  বলেছিলেন, " তোমার বাবা মায়ের ঠিকানা দিও অশোক। ওনাদের সাথে কথা বলার আছে কিছু।"


  অশোক বলেছিলেন, উনি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছেন। ওনার বাবা মায়ের পরিচয় জানা নেই। ঘরের পরিবেশ যেন বদলে গেছিল। সেদিন ওনারা কিছুই বলেননি। কিন্তু, পরে কল্যাণী বলেছিলেন ওনাদের আপত্তির কথা। অবশ্য কল্যাণী আশাবাদী ছিলেন তখনও। ভাবতেন যে, উনি ঠিক রাজি করিয়ে নিতে পারবেন।


  বাবা - মেয়ে কেউ নিজের সিদ্ধান্ত বদলাননি। কল্যানীর বাবার বক্তব্য ছিল, ছেলে ভাল হলেও অজ্ঞাতকুলশীল, বংসপরিচয় হীন, কার না কার পাপ। এ সম্বন্ধ ওনার অভিপ্রেত নয়।

মেয়ের ও জেদ কম ছিল না। সে বলেছিল বংশপরিচয়হীন অশোক শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় উঠে এসেছেন, এ তো আরো বড় কৃতিত্ব। আর নিঃশর্ত আনুগত্যের শিক্ষা তো বাবা তাকে দেননি। বরং সংস্কারের উর্ধ্বে উঠে বিচার করতে শিখিয়েছেন। তাহলে এখন বাবার সিদ্ধান্ত কল্যাণী কি করে মানবেন? 


  অনেকদিন চলেছিল এই ঠিক ভুলের টানাপোড়েন। তারপর কল্যাণীই বলেন, রেজিস্ট্রি করতে। অশোক অনুরোধ করেছিলেন আর একবার ভেবে দেখতে। উনি বলেছিলেন, "এতদিন ধরে ভাবিনি ভাবছো?"


  কল্যাণী সবসময় বলতেন, ওর বিয়েতে সেন বাড়ির আত্মীয়স্বজন মিলে এত লোক হবে অশোক সামলাবেন কি করে? ওনার তো লোকবল বলতে গুটিকয়েক বন্ধু। সেই কল্যাণী বিয়েতে এসেছিল একা। তাও তো বৌদি এসে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।


  আদুরে মেয়ে কল্যানীর চিন্তা ছিল বিয়ের পর তার আলমারী ভরা বই আর প্রিয় জিনিসপত্রের কি হবে। মাঝে মধ্যে বলতেন, " বাবা কে বলবো, ট্রাকে তুলে সব পাঠিয়ে দেবে। জায়গার ব্যবস্থা করো তুমি।"

রেজিস্ট্রির পরদিন সেই কল্যাণী পুরো খালিহাতে বেরিয়ে আসেন বাড়ি থেকে। বৌদি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর একবার ও পেছনে না ফিরে কল্যাণী এসে অশোককে বলেন, " আজন্মের সম্পর্কগুলোই যখন ফেলে এলাম, আর দু চারটে বই, জামা কাপড়ের মায়া করে কি হবে। "


  প্রথম কদিন অশোকের বন্ধু কৃশানুদের বাড়ি থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। অশোক ভাড়াবাড়ির খোঁজ করছিলেন। তখনই কল্যাণী বলেন হায়দ্রাবাদের ট্রান্সফারের সুযোগটা নিয়ে নিতে। অশোক একটু অবাকই হয়েছিলেন। যে কল্যাণী বলতেন, কলকাতা ছেড়ে কোত্থাও যাবেন না; সেই কল্যাণী নিজে অনুরোধ করে বাইরে চলে যেতে বললেন। আর ফিরে গেলোই না কোনদিন। 


  অথচ, কলকাতার প্রতি ভালোবাসা কিন্তু একটু ও কমেনি। সমস্ত খবর রাখতেন শহরের। মেয়েকে গল্প শোনাতেন। একবার তো অশোকের অফিসে অডিট করতে এলো কলকাতা থেকে। সেই রায়পুরের ঘটনা। কথায় কথায় বেরোলো অডিটর কল্যানীর পাড়াতুতো দাদা। ব্যস, আর কি। অশোক ও ভদ্রলোককে জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন রাতের খাবার খেতে বাড়িতে।

খুব খুশী হয়েছিলেন কল্যাণী। 


  খাবার পর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব গল্প করছিলেন পাড়ার। ছাতিম গাছটা আগের মত ফুলের গন্ধে মাতাল করে কিনা, দত্তবৌদির ছেলেরা কোন ক্লাসে উঠলো, সন্ধ্যা কাকীমা শংকরকাকাকে একই রকম বকাবকি করেন কিনা, ভুলো কুকুরটার বাচ্চাগুলো কেউ আর আছে কিনা - সব জানছিলেন অডিটর মিস্টার রায়, কল্যানীর অতনুদার থেকে। শুধু একবারের জন্য ও জানতে চাননি নিজের বাড়ির কথা। বাড়ির লোকজনের কথা। 


  মাঝে মধ্যে অবশ্য কল্যানীর দিদি ফোন করতো। তার মাতাল স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির ঝামেলা সামলে তার বেশি কোনোদিন কিছু করে উঠতে পারেনি। তবে এই নিয়ে কল্যানীর কোনো অভিযোগ ছিল না। 


  অশোক অবশ্য ভাবতেন। কল্যাণী নাহয় নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু, নবনীতার কি দোষ। বাবা অনাথ হওয়ায় সেদিকের কাউকে তো পেল না। মামার বাড়ি থেকেও মেয়েটা বুঝলো না সে কি জিনিস। একবার বলেওছিলেন কল্যানীকে সেই কথা।


  কল্যাণী বুঝিয়েছিলেন, যে সম্পর্ক থাকলেও কি এত দূর থেকে যাতায়াত করে যেত সবসময়? বরং টাউনশিপের পাড়া প্রতিবেশী, অশোকের কলিগ, এই সব কাকু- পিসি-মামা- মাসি নিয়ে দিব্যি থাকবে নবনীতা।



  নবনীতার জন্যই আবার বাগবাজারের বাড়ি গেছিলেন অশোক। দ্বিতীয়বার। ওর জন্মের কিছুদিন পরে। ওনার কলকাতায় যেতে হয়েছিল একটা ট্রেনিংয়ে।  কি জানি কি ভেবে গেছিলেন বাগবাজার। মেয়ের জন্মের খবর দিতে। বৌদি দরজা খুলেছিলেন। বৌদি নিজেই গেছিলেন শ্বশুরমশাইকে খবর দিতে। একটু পড়ে বৌদি ফিরে এসে ছলছল চোখে বলেন, " ভাই, তুমি আর এস না যে বাড়িতে। যদি কোনোদিন তোমার উপযুক্ত সম্মান জানাতে পারি, আমি নিজে তোমায় নিমন্ত্রণ করে আনব।"  আর হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। 


  আর অশোক যাননি। ফোন ও করেননি কোনোদিন। নবনীতার বিয়ের সময়েও না। কল্যাণী চলে যাওয়ার পরেও না। তবে খবর হয়ত ওরা পেতেন। ওর দিদির মাধ্যমে।


  সেই প্রেজুডিস আজও যায়নি? অবশ্য কল্যানীর মা কে দোষ দিয়েও লাভ নেই। উনি তাই ভেবেছেন যা ওনাকে বলা হয়েছে। বৌদির মত মানুষই বা কি করতে পেরেছেন ওই বাড়ির গন্ডীতে বাঁধা পড়ে?


  থাক। মেয়েটাকে কাল ফোন করে একটু বোঝাতে হবে। মায়ের মতোই আবেগপ্রবণ তো, অল্পেই বড় কষ্ট পেয়েছে। 

      


  দেশের আরেক প্রান্তে বসে তখন নবনীতার খুব রাগ হচ্ছিল। নিজের ওপরে। এই কলকাতা শহরটার ওপরে। সময়ের সাথে না বদলানো সংস্কারের ওপরে। বাবার সাথে কটেজ বলেও মনে শান্ত হইনি। খুব রেগে অর্ককেই ফোন করল নবনীতা। অর্ক আর ওর শহরের ওপর সমস্ত অভিমান উগরে দিয়ে সব বলল ওকে কি ঘটেছে।


  খুব শান্ত গলায় অর্ক বললো, " নবনীতা। তুমি কি ভেবেছিলে সব ভাঙ্গন জোড়া লেগে যাবে? একদিনেই? প্রথম বারেই? ও কি হয়? শুধু ভাব, যে আজ না গেলে তুমি তোমার মায়ের কত কথা জানতে পারতে না। সেটা খেয়াল হয়েছে?" 


  অর্ক ভুল হলে রাগ ধরে নবনীতার। কিন্তু, এখন ও ঠিক বলাতে রাগ যেন আরো বেশি হচ্ছিল। সেই রাগ নিয়েই ও বলে , " কিন্তু তোর শহরের ওপরে আমার বিশ্বাস উঠে গেল। আর কিছু নেওয়ার নেই আমার কলকাতা থেকে।"


  অর্ক খুব পরিণত ভাবে বলে, " কলকাতার ওপর অভিমান করছ? যাক অন্তত এই শহরের সাথে মন কষাকষির সম্পর্ক তো হয়েছে তোমার। আর ওঠানামা, রাগ অভিমান কোন সম্পর্কে থাকে না বলো তো? দেখো, দুদিন পরে এই শহরই তোমাকে বুকে টেনে নেবে।"


  বেকার জ্ঞান না শুনে ফোনটা কেটে দেয় নবনীতা।



পঞ্চম পর্ব 


    কদিন ধরেই অর্কর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ছবি আঁকায় মন বসছে না। খেলার জন্য কেমন পাগল ছিল, আর দুদিন ধরে পাড়ার বন্ধুরা বার বার ফোন করলেও খেলতে যায়নি অর্ক। টিভি দেখা, গান শোনা - কিছুই ভাল লাগছে না। নিজেই বুঝতে পারছে না কি চায় ও। নাকি বুঝতে চাইছে না?  

   

    বার বার ফোনটা  হাতে নিয়েও যার আশা করছে সেটা না পেয়ে আবার রেখে দিচ্ছে ও। অন্য কোথাও থাকলেও কান খাড়া থাকছে ফোনের আওয়াজের জন্য। এই তো, আজ দুপুরেই, খাবার সময় ফোনের রিং শুনে আনন্দে লাফ দিয়ে খাবার টেবিল থেকে লাফ দিয়ে ঘরে চলে গেছিল অর্ক। কিন্তু, ফোন দেখেই মাথা গরম হয়ে গেছিলো। মিষ্টি। সেই এক কথা বলবে নির্ঘাত - ‘কেন কলেজে আসছিস না? চলে আয় , তুই ছাড়া কিচ্ছু জমছে না।’ এইসব হাবিজাবি কথা শোনার বা তার উত্তর দেওয়ার মুড নেই এখন অর্কর। রাগে ফোনটা  কেটে দিয়েছিল অর্ক।  


    শালা, নবনীতার ও যে কি হলো? সেদিন কুমোরটুলি থেকে ফেরার পরেই কেমন যেন ডিটাচড হয়ে গেছে। আগে তো কত উৎসাহ নিয়ে সব প্ল্যান করছিলো দুজনে। এখনো তো কতকিছু বাকি। আরসালান না সিরাজ - কে বেশি ভালো বিরিয়ানি বানায় সেটা টেস্ট করতে হবে। গঙ্গার বুকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে নৌকো চেপে ঘুরতে এখনো বাকি।সকাল সকাল ফাঁকা ট্রামে চেপে শহরের এমাথা ওমাথা করা বাকি। এই শহরের সব ভালোলাগাগুলো ছুঁইয়ে দেওয়া বাকি। পুজো -  শীতের ময়দান - বইমেলা - কতসব এখনো বাকি রয়ে গেছে। আর এ মক্কেল ফোন তুলছে না। সেদিন যাওবা তুললো, ব্যস্ত আছে বলে রেখে দিলো। কদিন পরে নাকি আবার বেরোবে। পুরো দুদিন দেখেও যখন কোনো ফোন এলো না, অর্কই ফোন করলো। ফোন তুললোই না নবনীতা। পরে মেসেজ করে বললো যে পরে কথা হবে।


    কি যে হয়েছে নবনীতার সেটাই বুঝতে পারছে না অর্ক। কিছু সমস্যা হলো নাকি? অর্ক আবার কিছু ভুল ভাল বলেনি তো? হ্যা, সেদিন বাগবাজারে একটু বদমায়েশি করেছিল, কিন্তু তারপরেও তো কথা হয়েছে। ধুর শালা, মহিলাদের বোঝা বড় মুশকিল। ভালো লাগে না অর্কর, কিচ্ছু ভালো লাগে না।  

                              


    সল্টলেকের বাড়িতে বসে নবনীতার ও কিছু ভালো লাগছে না। শেষ অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার পর আর নতুন কোনো কাজ নেয়নি ও।  ঠিক মন বসছে না কোনো কাজে। অভিও সেদিন ওকে দেখে বলেছিলো, “একটা ব্রেক নিলে হয় না? তুমি যেন কলকাতা কলকাতা করে বড় দৌড়োচ্ছ। একটু রিলাক্স করো।” 

 খুব একটা ভুল বলেনি কথাটা। সেইমত কটা দিন একটু অন্যভাবে কাটাচ্ছে নবনীতা। ঘরেই থাকছে, খুব বেশি হলে বাজারে যাচ্ছে কিছু কেনাকাটা করতে।  এইসবের মধ্যে অর্ক একদিন ফোন করেছিল। ঠিক করে কথাও বলা হয়নি ছেলেটার সাথে। আর একদিন তো ফোন ধরতেই পারেনি। অবশ্য পরে কথা বলবে সেটা জানিয়ে দিয়েছে মেসেজ করে। আসলে একটু বিরাম নিচ্ছে নবনীতা, নিজের থেকে, কলকাতা থেকে। কিন্তু, তারপরেও মন খারাপটা যাচ্ছে না কেন? এই যে এখন শেষ বিকেলে কোথায় একটু চা খাবে, বই পড়বে; তা নয় আলো  নিভিয়ে হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। 


এর মধ্যে ডোরবেলের আওয়াজ পেয়ে অবাক হল নবনীতা। কে আবার আসবে এই সময়ে? অভি বোধহয় কিছু অর্ডার দিয়েছে অনলাইনে। বলেনি তো। আচ্ছা, সারপ্রাইজ দেওয়া হচ্ছে! উঠে চটজলদি মুখেচোখে একটু জলের ছিটে দিয়ে দরজা খোলে ও। মাধবীকে দেখে অবাকই হয় নবনীতা।


মাধবী বলেন, “কিছু না জানিয়েই চলে এলাম। কাছাকাছি আমার এক মাসতুতো বোনের বাড়ি আছে, তোমায় না পেলে ওখানেই চলে যেতাম। ভালোই হলো, তুমি আছো।”  প্রথমে দরজাটা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে করলেও মত বদলে ওনাকে ভেতরে আস্তে বলল নবনীতা। 


সোফায় বসে আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে মাধবী বললেন, “ মা কে খুঁজতে গিয়ে চলে এসেছিলে। দেখো, তোমার জন্য কি নিয়ে এসেছি। “ এতক্ষনে নবনীতার চোখে পড়লো যে মাধবীর সাথে একটা বেশ বড়সড় ব্যাগ আছে।  কি এনেছেন উনি? কি আনতে পারেন? 

হাসিমুখে মাধবী ব্যাগ থেকে একটা কালো বেশ বড় বই বের করলেন। কিন্তু, বই কি ওই সাইজের হয় নাকি? না না, এ তো আলাদা জিনিস। মনে পড়লো নবনীতার। অ্যালবাম!


-- ‘ অনেক খুঁজতে হয়েছে, তারপর বেরোলো। আসলে এখন তো আর এইসবের চলন ও নেই, কেউ খুলেও দেখে না। তবে মনে হলো তোমার ভাল লাগবে।  


নবনীতা তখন নতুন আবিষ্কারের আনন্দে শিহরিত হচ্ছে। মা এর ছবি থাকবে এইখানে। অ্যালবাম খুললো নবনীতা।  কিন্তু, শুরুর ছবি তো অনেক আগের। ও একটু প্রশ্নের চোখে তাকালো মাধবীর দিকে।  উনি অ্যালবামটি টেনে নিয়ে বললেন, এসো , একসঙ্গে দেখি। 


-- “ এই ছবিটা অনেক আগের। এই দেখো বাবা, পিসিমা, পিসেমশাই, আর ওই যে মা বসে আছেন। মা কে তো বোধহয় চিনতে পারছো, সেদিন দেখলে তো।  যদিও চেহারা এখন অনেক ভেঙে গেছে। আর এই যে ওরা তিন  ভাইবোন। এই যে দিদি, কলির দাদা আর ওই যে ফ্রক পরে আঙ্গুল চুষছে, ওটাই কলি। তোমার ছোটমামার জন্মের আগের এই ছবিটা।  “


হটাৎ কেমন হালকা লাগছে শুরু করে নবনীতার। বেশ কিছুক্ষন এই ছবিটা দেখে তারপর ও মাধবীকে বলে, “ পাতা ওল্টাও, মামী।” 


মাঝে একবার উঠে চা আর অল্প কিছু জলখাবারের ব্যবস্থা করে নবনীতা। তারপর আবার জমে ওঠে দুজনের ছবি দেখার পালা। খুব বেশি ছবি না হলেও কোনো অনুষ্ঠান, বিয়েবাড়ির সুযোগে তোলা ছবিগুলো ও অনেক নবনীতার কাছে। যেন একটা অচেনা দরজা খুলে গেল ওর সামনে। স্কুলের পোশাকে মা, বাড়িতে পুজোর সময় ভাইবোনদের সাথে মা, দাদা দিদি আর ভাই এর সাথে মা, দাদার বিয়েতে মা, মামী এর সাথে মা - মা এর ছোটবেলা থেকে শুরু করে বড় হওয়া ইস্তক এতো ছবি দেখে খুব মজা লাগছিলো নবনীতার। আর একই সাথে একটু একটু করে মা এর জন্য খুব কষ্ট ও হচ্ছিল ওর।  


ওই কষ্টের চোরাস্ত্রোত বোধহয় মামীকেও ছুঁয়েছিল। উনিও ছবি দেখা থামিয়ে শুরু করলেন কথা বলা।  


-- “ সেদিন মায়ের  কথাতে তুমি খুব দুঃখ পেয়েছো জানি। ওরকম বলা ওনার অন্যায়।  তবে কি জানো, উনি তো চিরকাল বাবার কথাই বেদবাক্য মেনে এসেছেন, এখনো তাই ভুল বুঝতে পারেন না।আমি ও কি কিছু পেরেছিলাম? মাঝে মধ্যে দিদি কিছু খবর দিত তোমাদের। খুব ইচ্ছে হতো আমার একবার যেতে, কলির সাথে দেখা করতে। কিন্তু.. 

তোমার মামা এমনিতে লোক খারাপ নন। কিন্তু এই ব্যাপারে প্রচন্ড একগুঁয়ে ছিলেন। এখন নাহয় আমি অত  মানিনা, তখন তো আমিও বেশি কিছু বলতে পারতাম না।  কতগুলো বছর খালি খালি নষ্ট হয়ে গেলো। দুহাজার দশ নাগাদ চেনা কয়েকজন তীর্থে যাচ্ছিলো। ওই বৃন্দাবন, মথুরা এইসব। আমার কোনোকালে ধর্মকর্মে তেমন মন না থাকলেও আমি তোমার মামাকে রাজি করিয়ে গেছিলাম। শুধু দিল্লি হয়ে যাচ্ছিলো বলে। ফেরার সময় ৫ ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছিল দিল্লির রেল স্টেশনে।  বার বার শুধু ভেবেছি, যদি কলির ঠিকানাটা থাকতো।সব লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি - কলি বা অশোক যদি কোনো কাজে এসে থাকে স্টেশনে। অমন কপাল আমার হলে তো হয়েই যেত।"


হাত দিয়ে চোখের জল মোছেন মামী।নবনীতা এক গ্লাস জল এগিয়ে দেয়।  এক চুমুক জল খেয়ে মামী আবার কথা শুরু করেন, “ কলি যে অসুস্থ সেটা আমি জানতাম না জানো। আমরা কেউ জানতাম না। যখন জানলাম, তখন ও সব সুখ অসুখ ফেলে চলে গেছে। দিনটা রোববার ছিল। অনেক মাছ মাংস আনা হয়েছিল বাড়িতে। আমাদের ছেলে রুনুকে ডেকে তোমার মামা খবরটা দিলেন। বললেন, ছোটোপিসির জন্য যেন রুনু অশৌচ পালন করে।  আমায় ডেকে বললেন মাছ মাংস লোকে দিয়ে দিতে।  কোনোদিন তো কিছুই বলিনি, সেদিন বলেছিলাম। 


বলেছিলাম, ‘রুনুর ছোটপিসি তো তোমাদের জন্য অনেকদিন আগেই মারা গেছেন।  তার জন্য আজ কেন  অশৌচ করবে। আর এতকাল মেয়েটার কথা মনে পড়ল না , বোনকে একবার দেখতে ইচ্ছে হলো না।  সে চলে গেছে শুনে তার স্বামী , মেয়ে কেমন আছে একটা ফোন করার কথা মাথায় এলো না ; এলো খালি অশৌচ পালনের কথা? তোমরা সব খাবে। মাছ মাংস সব। অনেক সহ্য করেছি সারাজীবন। আজ তোমাদের শোকের নাটক সহ্য করতে পারবো না আমি।’ জানো , সেদিন প্রথমবার আমি খুব চিৎকার করেছিলাম। কাউকে মানিনি। তারপর বেরিয়ে গিয়ে মন্দিরে চলে গেছিলাম। সেখানে বসেছিলাম সারা বিকেল।  আর কোথাও যাওয়ার নেয় বলে আবার আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরেছিলাম সন্ধ্যেবেলায়। সেই যে মেয়েটা এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, আর কোনো দিন দেখতেই পেলাম না।”


  

নবনীতা সান্তনা দেয়,” মামী, মন খারাপ করো না মামী। মন খারাপ করো না। মা ও তোমার কথা বলতো খুব। তোমাকে খুব মিস করতো। আমার বিয়ের দিন ও বলেছিলো, তুমি নাকি দারুন আল্পনা দাও।  তুমি থাকলে সবাই চমকে যেত আল্পনা দেখে।” 


মামী চোখ মুছে বললেন, “ তাই? এতো কিছু বলতো? হ্যাঁ রে মা, জামাই কখন ফিরবে? “

ঘড়ি দেখে নবনীতা বললো ,” অন্যদিন আটটা র মধ্যে চলে আসে, তবে আজ একটু দেরি হবে বলেছে। সবে তো সাতটা।”

 -- “ ও বাবা, অনেক রাত হয়ে গেছে, আমি উঠি এবারে। এই অ্যালবামটা তুমি রাখো। ওবাড়িতে এর কদর করার মত কেউ নেই।”


ক্যাব্ বুক করে মামীকে গাড়িতে তুলে দিলো নবনীতা। তারপর নিজের মনেই ভাবছিল, আজ মামীর সাথে কথাতেই জানল যে উনি সুন্দর আল্পনা দিতেন।  আর তাই হটাৎ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল , যে মা বিয়ের দিন ওই কথা বলেছিলেন। তবে সত্যি বলতে গেলে, বলতেই পারতেন। না বলার কিছুই ছিল না।  আর তখনই নবনীতা বুঝলো যে শুধু যা ঘটে তাই নয়, যা হতে পারত, যা কোনোদিন হয়নি - কখনো কখনো সেই সব ও সত্যি হতে পারে।   




ষষ্ঠ পর্ব



  – " কি বলছো? পুজোয় কলকাতা থাকবে না তুমি? তার আগেই মিউনিখ চলে যাবে? "

 – " কি করব বল? অভির ট্রান্সফার আজ নয় কাল হওয়ারই ছিল। একটু আগেই হয়ে গেল। সব মিটিয়ে যেতে যেতে ওই মহালয়া হয়ে যাবে।"

  – " অভিদা যাক না, তুমি নাহয় কদিন পরেই যেও। মহালয়া যখন হয়েই যাচ্ছে, আর তো কটা দিন।"

  – " আমি অভিদার কদিন পরেই যাচ্ছি অর্ক। কিন্তু, না রে, এটা আর পিছনো যাবে না। অনেক ফর্মালিটি থাকে তো।" 

  – " তুমি না নবনীতা, একেবারে যাচ্ছেতাই। ধুর শালা, প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তোমার ওপরে।"

  –" বাজে বকিস না অর্ক। আর হ্যাঁরে, ঐ ছবিটার কি হল? এবার তো দে। এত কিছু গোছাতে হবে আস্তে আস্তে। আর দেরি হলে সব ভুলে যাব। 

  – "দেব না।"

  – " মানে?"

  – " ঐ ছবি পেলেই তো আমায় ভুলে যাবে। আর ওটা দিয়ে দিলে আর কি বাহানায় তোমার সাথে যোগাযোগ করব বল তো? সেজন্য ওই ছবি কোনোদিন শেষ ও করব না, তোমায় দেব ও না।"

  – " আরে বোকা, বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে বাহানা লাগে?"

  – " সেটাই। বন্ধু! শোনো, আমি ফোন রাখছি বুঝলে,  মা অনেকক্ষন ধরে ডাকাডাকি করছে।" 


  ফোনটা রেখে অর্কর কথাই ভাবছিল নবনীতা। অভির ট্রান্সফার এত জলদি হয়ে যাবে ও নিজেও ভাবতে পারেনি। তবে, জার্মানি যাবার এই সুযোগ ছেড়ে দিলে আবার কবে আসবে তার ঠিক নেই। আর সত্যি বলতে কলকাতা ছেড়ে যেতে যে নবনীতার ও খারাপ লাগছেনা, তা নয়। তবে আজ নাহয় কাল, যেতে তো হবেই। তাহলে আর খামোখা মায়া বাড়িয়ে কি হবে? মনকে বেশী আশকারা দেয়না নবনীতা। আর অর্ক কি জানি বলছিল? অবশ্য ওর কথা ভেবে লাভ নেই। মাথা খারাপ ছেলে একটা।


  তবে যাওয়ার খবর শুনে সবাই এরকম ভাবেই রিয়াক্ট করছে। বাবা যখন বললেন, "আরো দূরে যাওয়াই ঠিক করলি তবে?", কোনো উত্তর দিতে পারেনি ও। কি বলত? দূর থেকে আরো দূরে, ছড়িয়ে পড়াটাই যে নিয়ম। 


মাধবী, মানে বড়মামীর উত্তর বরং বোঝা অনেক সোজা। উনি শুনে বলেছিলেন, " জামাইকে এখনো চোখের দেখা দেখতে পেলাম না, আর আরো দূরে চলে যাচ্ছিস? ছেলেটাকে একটু খাতির যত্ন করার সুযোগ ও দিবি না?"

  হেসে নবনীতা বলেছিল, "তাই বলো মামী। জামাই বলে কথা।  জামাই আদর করতে তো তোমার হাত নিশপিশ করছে।"

  মাধবী ম্লান হেসে বলেছিলেন, "ঠিক তা নয় রে মা। কলি থাকলে কত কি করত ভাব। একমাত্র মেয়ের জামাই। কত সাধ থাকে মানুষের।"

  নবনীতা ও সুর মিলিয়ে বলেছিল, "মা তো আমার বিয়ের পরপরই অসুস্থ হয়ে গেছিল। অভির কপালে  স্পেশাল খাতির তাই কোনোদিনই জোটেনি।"


  মামীকে জানিয়েছিল যে এখনো কিছুদিন আছে ওরা এখানে। যেতে যেতে পুজো এসে যাবে। মামীও খুশী হয়েছিলেন এই ভেবে যে কদিন সময় পাওয়া গেল।


  কিন্তু আস্তে আস্তে দিনগুলো কমে যেতে থাকে। এর মধ্যেই আবার অভির কাছে ওর কলিগরা পার্টি দাবি করে। অল্প কিছু লোকজন হওয়াতে ওদের বাড়িতেই ব্যবস্থা হয় সেই পার্টির। 


  রাত বেশী হয়নি। ওই আটটা-নটা বাজে। পান ভোজন, আড্ডা, অফিসের গল্প, একে ওকে নিয়ে ইয়ার্কিতে পার্টি পুরো জমে উঠেছে। এমনিতে ওয়েস্টার্ন ক্যাজুয়াল পছন্দ হলেও আজ পার্টির খাতিরে একখানা জম্পেশ দেখে কালো সিল্কের শাড়ি পড়েছে নবনীতা। পারফেক্ট হোস্টেস হতে হবে যে।


  হটাৎ বেল বাজলে অভি আড্ডা থেকে উঠে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললো, " মনে হয় বিবেক ফাইনালি আসতে পেরেছে।"  একটু পরে অভির ডাকে নবনীতাকে ও উঠতে হলো। বিবেক নয়, অন্য কেউ। নবনীতাকে খুঁজছেন। ডান হাতে ওয়াইন গ্লাস আর বাঁ হাতে আঁচল সামলে দরজায় গিয়ে নবনীতা দেখে উস্কোখুস্কো চুল নিয়ে অর্ক দরজায় দাঁড়িয়ে।


  অবাক অবশ্য অর্ক ও হয়েছে। সেটা বলেই ফেলে ও।


  –"বাবা, আজ তো পুরো ভোল বদলে ফেলেছো। ব্যাপারটা কি?"

  – " আরে কিছু না, পার্টি চলছে একটা। আয়, ভেতরে আয়।"

  – " না গো, ওয়াইন দেখে লোভ লাগলেও আজ নয়। আর একদিন আসব। ও হ্যাঁ, যার জন্য এলাম। এই নাও।" এক খানা বড় প্যাক করা ক্যানভাস এগিয়ে দেয় অর্ক।

  চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নবনীতার। জিজ্ঞেস করে, " যা ভাবছি, তাই কি? তবে তুই যে বলছিলি…"

  – " এটা না দিয়ে কি তোমায় ধরে রাখতে পারবো? তাই … পরে খুলে দেখো। যা ভেবেছো, সেরকম হলো কিনা। জানিও।" এই বলে বেরিয়ে পড়ে অর্ক।


  অর্কর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে নবনীতা। তারপর দরজা আটকে  ক্যানভাসটা নিয়ে বেডরুমে ঢোকে। খাটের একপাশে রেখে দেয় ওটাকে। খুব ইচ্ছে হলেও ওটা এখন ও খুলবে না। বড্ড গোলমাল এখন। পার্টির পরেও না। কাল অভি অফিস চলে গেলে তখন সময় নিয়ে খুলবে ও এটাকে। দেখবে, অর্কর চোখে নিজেকে। একা। হালকা একটু হাসি হেসে আবার পারফেক্ট হোস্টেস নবনীতা ফিরে চলে পার্টিতে।


  পরদিন অভি চলে যাওয়ার পর ঘরের কাজকর্ম তাড়াতাড়ি শেষ করে ক্যানভাসের প্যাকেটটা বের করে নবনীতা। প্যাকেট খোলার আগে নিজেরই হাসি পেয়ে গেল কিভাবে এই ছবি শুরু হয়েছিল সেই ভেবে।

  প্যাকেট খুলতেই একটা খাম বেরিয়ে পড়ল। পাশে সরিয়ে রাখল ও সেটাকে। আগে ছবি। ক্যানভাসটা উল্টো বেরিয়েছে। চোখ বন্ধ করে ওটাকে সোজা করে নবনীতা। তারপর আস্তে আস্তে চোখ খোলে ও।


  এ তো পোর্টেট নয়। তবে নবনীতা আছে এখানে। বাঁদিক ঘেষে। ওর প্রোফাইল। ছবির নবনীতা তাকিয়ে আছে ক্যানভাস এর মাঝের হাসিমুখের এক পুরুষ আর নারীর ঝাপসা অবয়বের দিকে। আর তার পেছনে রয়েছে ভিক্টরিয়ার আউটলাইন আর কলকাতার স্কাইলাইন।


  ছবিটা বুঝতে পেরে হাসি ফুটে ওঠে ওর মুখে। না, যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে এটা। ও আর কি একটা ছিল না। এবার খামটা খোলে ও।

   ভাঁজ করা কাগজটা বের করে অর্কর সুন্দর হাতের লেখা পড়তে শুরু করে নবনীতা।


  'নবনীতা।


এভাবে বলছি বলে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। কিন্তু, বারবার রিহার্স করে গেলেও  তোমার সামনে গিয়ে আমার কথারা সব হারিয়ে যায়। তাই …


  ছবিটা ভেবেছিলাম শুধু তোমার আঁকবো। কিন্তু, তুমি শেখালে গল্প বলতে। তাই তোমার ছবিতে তোমার সঙ্গে রইলেন তোমার বাবা-মা, তোমার মায়ের শহর, আমার শহর, আর হয়ত আমিও।


  ছবিটা ভাল লাগলে একটা অনুরোধ করব। রাখবে? একবার। সব কিছু ভুলে গিয়ে শুধু একটা দিন। দেবে আমাকে?


  কোনো কথা না। শুধু তুমি আর আমি। পাশাপাশি। ট্রামলাইন ধরে হাঁটব। ঘোড়ার গাড়িতে বসে বৃষ্টি ভিজব। কফি খাব। শুধু তুমি আর আমি। কোনো কথার ভীড় থাকবে না।


  দেবে এমন একটা দিন আমাকে? শব্দহীন। এক দিন। তুমি আর আমি। ব্যাস। দেবে? নবনীতা?


 জানিও।'


কাগজটা ভাঁজ করে বসে থাকে নবনীতা। এক ঢোক জল খায় ও। খুব মিস করতে থাকে অভিকে। কতদিন হয়ে গেল ওরা একসঙ্গে সময় কাটায়নি। অভিকে ফোন করে ও।


  – " বলো, কি হয়েছে?" জিজ্ঞেস করে অভি।

  – "একটা দিন দেবে আমায় অভি। জাস্ট একটা দিন। ভিক্টরিয়ার পাশে ঘোড়ার গাড়ি চড়ব। ট্রামে করে কলকাতা ঘুরব। ইচ্ছে করে না তোমার?" প্রশ্ন করে নবনীতা।


  – " সুইট হার্ট। এখন যাওয়ার আগে আমি প্রচন্ড বিজি। একটুও সময় নেই। এক কাজ করছি। আমি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি দিয়ে তোমার ঘোড়ার গাড়ি, ট্রাম সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ওকে?ইউ এনজয়। "

.

  ফোনটা রেখে বসে থাকে নবনীতা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, পুরুষ যে কেন বোঝে না।


  তারপর কি ভেবে আবার ফোনটা তুলে নেয়। মেসেজ পাঠায় অর্ককে: ' ইটস আ ডেট। ফিক্স আ ডেট।"



সপ্তম পর্ব 






    অর্কর সাথে বেরোনোর প্ল্যান হলেও নবনীতা বার বার চাইছিল ওটা এড়িয়ে যেতে। কিন্তু যতবার কোনো কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে ও, বারবার ব্যর্থই হয়েছে। যাওয়ার আগের ব্যস্ততার কারণে অভি শনি রবি কিছুই মানছে না, রোজ দিনই অফিস যাচ্ছে।  দেরি করে ফিরছে। আর নবনীতা আরও একা হচ্ছে।  



শেষ অবধি শুক্রবারে বেরোনো ঠিক হলো অর্ক নবনীতার। মিউজিয়ামের সামনেই দাঁড়াবে অর্ক।  নবনীতা বারোটা নাগাদ পৌঁছে যাবে। তারপর ওখান থেকে সারাদিনের প্রোগ্রাম। দোটানা ভাবটা কিছুতেই কাটছে না নবনীতার।  



শুক্রবারটা যেন কেমন তাড়াতাড়ি এসে গেল।  ব্রেকফাস্ট করেই অভি বেরিয়ে গেল। ওর নাকি খুব ইম্পরট্যান্ট কাউকে রিসিভ করতে হবে। তারপর সারাদিন তার সাথেই থাকার কথা। সবই অভির কাছে জরূরী, শুধু নবনীতা ছাড়া। থাক। আজ আর এসব ভেবে লাভ নেই।  



স্নান করে সবে তৈরী হতে বসবে এমন সময় ডোরবেল বাজল। নিশ্চয় আবার ক্লাব থেকে পুজোর চাঁদা চাইতে এসেছে। বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতে এগোয় নবনীতা। 



দরজা খুলে অভিকে দেখে অবাক নবনীতার মুখ দিয়ে শুধু বেরোয়, “তুমি?" নির্ঘাত কিছু ফেলে গেছে অভি, নইলে এতো তাড়াতাড়ি আবার ফিরে এলো কেন? নবনীতার প্রশ্নের জবাবে শুধু মিটিমিটি হাসতে অভি। এইসময়ে নবনীতাকে আবার অবাক করে দিয়ে অভির পেছন থেকে উঁকি মেরে অশোক বলেন “সারপ্রাইজ"। 



-- "বাবা তুমি! কলকাতায়? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না?" আজ অবাক হওয়ার কি শেষ নেই নবনীতার?

-- “আরে, সব দরজায় দাঁড়িয়েই বুঝতে হবে না কি আংকেলকে ঘরে ঢুকতে বলবে? আমি নাহয় বাইরেই থাকছি।” অভির কথায় খেয়াল হয় নবনীতার।  


 জিনিসপত্র রেখে ঘরে বসেন অশোক। বাবাকে পেয়ে নবনীতার কথা আর প্রশ্ন যেন ফুরোতেই চায় না।  অভি জানায় যে ও আজ কাল সারাদিন ছুটি নিয়ে রেখেছে অশোক আসছেন বলে। ঐজন্যই বকেয়া কাজ নামাতে ওকে ছুটির দিনেও অফিস করতে হয়েছে।


অশোক তাড়া দেন মেয়ে জামাইকে, " চলো চল অভি। জলদি কর মামণি। বেরোতে হবে তো।"

 

– "কোথায় যাব আমরা?" 


নবনীতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফোন বের করে একটা নম্বর ডায়াল করতে করতে অভি বলে, "দ্যাটস অ্যানাদার সারপ্রাইজ। নাও, কথা বলো।" অভির বাড়ানো হাত থেকে যন্ত্রের মত ফোনটা নিয়ে কানে দেয় নবনীতা।


– " দেরি না করে বাবা আর অভিকে নিয়ে চটপট চলে আয়রে মা।" বড়মামী মাধবীর গলা ভেসে আসে ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে।


– " আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মামী? কি ব্যাপার? বাবা… অভি…" পাজলড হয়ে যাচ্ছে নবনীতা।

মাধবী বোঝানোর চেষ্টা করে বলেন, " অত বোঝার কিছু নেই, ধরে নে না, আজ জামাইষষ্ঠী।"


– " হ্যাঁ! জামাইষষ্ঠী? সে তো গরমকালে হয় না? এখন কি করে?"


– " ঠিকই বলেছিস মা, তবে কি বল তো, আসল উদ্দেশ্য তো হল জামাই এর কল্যাণকামনা। তিথি নক্ষত্র সব গৌণ। আর শোন, আমরা যদি মায়ের পুজো অকালে করতে পারি,  তবে জামাইষষ্ঠী ও সেপ্টেম্বর মাসে করা যাবে। দুটি বাঙালি ছেলে একটু খাবে দাবে এই তো।"  


– " তুমিও পারো মামী। তবে দুজন জামাই বাঙালি নয় কিন্তু। অভি অভি করি বলে কি ভেবেছ? ওনার নাম অভিষেক সিং। ভদ্রলোক পাঞ্জাবি।"


–" ঐজন্যই কানে লাগছিল ওর কথা। যতই বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে বাংলা বলুক, আমার কানে ঠিক ধরা পড়ে। আর পাঞ্জাবি তো কি? এক প্রজন্ম তো বংশ নিয়ে কাটিয়ে দিলো। এখন আর কোনো অজুহাতেই আমি কাছের লোক দূরে ঠেলব না। একটা কথা বল, জামাই মাছ মাংস খায় তো?"


– " সব খায় গো মামী। এ ব্যাপারে উনি তোমার যে কাউকে কম্পিটিশন দেবেন।"


– " যাক বাবা, নিশ্চিন্তি। হ্যাঁ রে, একবার অভিষেককে ফোনটা দে তো।"



কথা বলতে বলতে অভিষেক এর চোখমুখ কেমন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নবনীতা আর অশোকের কৌতূহল নিরসন করে ও বলে, "মামী ডেঞ্জারাস কন্ডিশন রেখেছেন। বলছেন, ধুতি পরে যেতে হবে।" 



অভির এক্সপ্রেশন আর মামীর শর্ত শুনে নবনীতা হেসে লুটিয়ে পড়ে। কেমন জব্দ। মেয়েকে ইগনোর করে অশোক বলেন, "চিন্তা নেই। তোমার বিয়ের ধুতি পাঞ্জাবি আমি নিয়ে এসেছি। ও তো এমনিতেই আমাদের বাড়ি পরে থাকত। এমন কিছু আন্দাজ করেই নিয়ে এসেছি।" 



– " কিন্তু আঙ্কেল, বিয়ের সময় তো নবনীতার এক ফ্রেন্ড কোনোভাবে ম্যানেজ করে দিয়েছিল। আজ কি হবে?" 



– " আরে বাবা, আমি তো আছি। চল, সব করে দিচ্ছি।" অভিকে অভয় দেন অশোক।



কিছুক্ষন পর ধুতি পাঞ্জাবি পরা অশোক আর অভির সাথে গাড়িতে বাগবাজার যেতে যেতে বাকি কথা শোনে নবনীতা অশোকের কাছে।



– " বৌদি যখন আমায় ফোনে আসতে বলেন, আমি মানা করছিলাম। তারপর দাদা, মানে তোর বড়মামা ফোন করেছিলেন। বললেন, 'ক্ষমা চাওয়ার মুখ তো আমার নেই ভাই। এই সব তুচ্ছ কারণে বোনের সাথে তো আর ইহজীবনে দেখা হলো না। ওপারে গিয়ে যাতে ওর কাছে ক্ষমা চাইতে পারি, সে সুযোগ টুকু দাও। তোমরা এস। কলির কথা ভেবে।' বুঝলি মামণি! সেইজন্যই। যার কথা ভেবে কলকাতা ছেড়েছিলাম, তার জন্যই আবার ফিরে এলাম।"



কথায় কথায় একবার হাতঘড়ি দেখল নবনীতা। সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। আর জানি কোথায় যাওয়ার ছিল। ও…



আধঘন্টার ওপর দাঁড়িয়ে অর্ক তখন বিরক্তের থেকেও বেশি অভিমানী। নবনীতার নাহয় আসতে দেরী হচ্ছে। তাই বলে ফোন তো ধরতে পারে। ফোন ও কেটে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর একটা মেসেজ এলো। 'সরি' । ব্যাস, আর কিছু না। 



চলেই যাচ্ছিল অর্ক। হটাৎ পেছন থেকে মিষ্টির ডাকে দাঁড়িয়ে গেল।

   

– " এতোদিন পরে এদিকে এসেছিস, ক্লাসে চল।"

– " না রে, একটু ডিস্টার্বড আছি। একবারে সোমবার থেকে আসবো। আজ চলি।" মিষ্টিকে কাটায় অর্ক।

– " দাঁড়া। আমিও যাব তোর সাথে। অনেক কথা আছে। চল, হাটবি?"


মিষ্টির সাথে কথা বলতে বলতে ময়দানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অর্ক ভাবে, এভাবেই বোধহয় ভুলগুলোকে ঠিক করে দেয় কলকাতা। 



ছোট থেকে চিরকাল অশোককে অনেকভাবে দেখেছে নবনীতা। কনফিডেন্ট, দায়িত্ববান, স্থির অশোক নবনীতার চেনা। কিন্তু, আজ বাগবাজারে মামারবাড়ি তে ঢোকার সময়  দরজায় মামা মামীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যে লাজুক লাজুক ভাব অশোকের চোখেমুখে খেলে গেল সেটা কোনোদিন দেখেনি ও। অভির মধ্যেও সেই একই ভাবের প্রতিফলন দেখে একইসাথে বাবা আর মায়ের জন্য কষ্ট আর ভালো লাগায় মনটা কেমন করে উঠল। ভাগ্যিস, ও এসেছিল সেদিন এই বাড়িতে। 



অভি চলে যাওয়ার দিন দশেক পর  দ্বিতীয়াতে নবনীতার যাওয়ার ব্যবস্থা হওয়াতে অশোক ও থেকে গেলেন মেয়ের কাছে। দিল্লি হয়ে ফ্লাইট গেলেও নবনীতা যাবে ব্যাঙ্গালোর হয়ে। অশোক আর ওর টিকেট একদিনেই কাটা হলো। সব গুছিয়ে এয়ারপোর্টে এসে দেখল ওকে সী অফ করতে বড়মামা আর মামী এসেছেন। 



বিদায়বেলায় সবার কথা শুনলেও কোনোকিছুই যেন আর ছুঁতে পারছিল না নবনীতাকে। মামা মামীর সাথে কথা বলতে বলতে নবনীতার চোখ বার বার ভিড়ের মধ্যে চলে যাচ্ছিল। খুঁজছিল একটা হাসিমুখ, আর 'নবনীতা, তুমি না যাচ্ছেতাই'  আর একবার শোনার জন্য কান আকুল হয়ে উঠছিল।  সবাই বারবার তাড়া দিচ্ছিল এয়ারপোর্টে ঢুকে যেতে। "আর একটু" , "আরে সময় আছে" এইসব বলতে বলতে নানা বাহানায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল ও। সময় আর অজুহাত দুটোই ফুরোলে এগিয়ে গিয়ে এয়ারপোর্টের গেটে টিকেট দেখানোর জন্য ফোন বার করতেই একটা মেসেজ দেখতে পেলো নবনীতা। 



'সরি'! 



দীর্ঘশ্বাস ফেলে একবার কলকাতার দিকে শেষ নজর দিয়ে এগিয়ে চলল নবনীতা। কেন জানি ওর পা চলতে চাইছে না। এই নিয়ে এগারো বার শহর বদলাচ্ছে ও। বাড়িঘর, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে যেতে প্রতিবারই কষ্ট হত। আর কলকাতায় তো ছিল ছয় মাসের ও কম। কেন তবে এরকম লাগছে ওর?

কেন বুকের ভেতর কেউ গুমরে গুমরে  কাঁদছে? কেন আবার এই ধুলোধোঁয়ার শহরে কবে আসবে ভেবে মন আনচান করছে। তবে কি ভবঘুরে নবনীতার শিকড় গজিয়ে দিল কলকাতা? 



প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজে পেল নবনীতা। আরো কিছুক্ষন পরে। ব্যাঙ্গালোর থেকে প্যারিসের ফ্লাইট। সেখানে আবার চেঞ্জ করতে হবে। ব্যাঙ্গালোর থেকে ওড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সহযাত্রী এক কন্নড় বয়স্ক ভদ্রমহিলা নবনীতাকে যখন জিজ্ঞাসা করলেন, " ইউ আর ফ্রম?"

– " কলকাতা।" 

– " ওহ, ওখানেই জন্ম, বেড়ে ওঠা সব?"

– " কোনোটাই নয়। কারণ জানতে চাইলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু, ভালোবাসার কি আর লজিক হয়? তাই আমি কলকাতার।" উত্তর দিয়ে নিজের ভাবনায় ডুবে গেল নবনীতা।  



মান অভিমানের শহর। আবেগের শহর। ভুল বোঝাবুঝি, হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক ফিরে পাওয়ার শহর। কখনোই পুরো হাত খুলে না দিয়ে, কিছুটা নিজের মুঠোয় লুকিয়ে রেখে দেওয়ার শহর। তিরিশ বছরের অভি আর বাষট্টি বছরের অশোকের লাজুক মুখে একসাথে প্ৰথম জামাইষষ্ঠীর শহর। সব পাওয়া না পাওয়া ভুলিয়ে দিয়ে কাছে টেনে নেওয়ার শহর। আমার শহর।




সমাপ্ত